বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:৪৭ পূর্বাহ্ন

খুলনার কৃষক আরুনি ১০ ধরনের নতুন ধান উদ্ভাবন করেছেন

নিউজ ডেস্ক :: এক দশক আগে ফিলিপাইনের কৃষিবিজ্ঞানী বংকায়া বানের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন কৃষক আরুনি সরকার। তারপর সংকরায়ণের মাধ্যমে ১০ ধরনের স্থানীয় আমন ধান উদ্ভাবন করেছেন নিজেই। আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না পেলেও তাঁর উদ্ভাবিত ধানগুলোর মধ্যে ছয় ধরনের ধান চাষাবাদ করছেন কৃষকেরা।

কৃষিই আরুনি সরকারের জীবিকা। বাড়ি তাঁর খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার গঙ্গারামপুর গ্রামে। ৪২ বছরের আরুনির পড়াশোনা মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোয়নি। তাতে কি, স্থানীয় মানুষদের কাছে এই আরুনি সরকারই যে ‘ধান গবেষক’। ১০ বছরের চেষ্টায় সংকারায়ণ করে তিনি ১০ ধরনের নতুন ধান উদ্ভাবন করেছেন। এগুলোর মধ্যে ছয় রকমের ধান এবার স্থানীয়ভাবে চাষ করা হচ্ছে।

আরুনি সরকারের উদ্ভাবিত ধানগুলো উপকূলীয় অঞ্চলের লবণাক্ততা ও জলাবদ্ধতা সইতে পারে। ফলনও ভালো। তুলনামূলক কম কীটনাশক ও সার প্রয়োগ করতে হয়। দুই বছর আগে যখন খুলনা অঞ্চলে ‘কারেন্ট’ পোকার (বাদামি গাছফড়িং বা গুনগুনি পোকা) আক্রমণে অধিকাংশ খেতের ধান নষ্ট হয়ে যায়, তখনো খেতে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল আরুনির ধান। যা দেখে আশপাশের কৃষকদের আগ্রহ বাড়ে। আরুনির কাজকে তাঁর ভাই তরুণিকান্ত সরকার ‘পাগলামি’ মনে করতেন। সেই ঘটনার পর তিনিও শুরু করেছেন আরুনির উদ্ভাবিত ধান চাষ।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা লোকজের কৃষক ফেডারেশনের সদস্য ছিলেন আরুনি সরকার। সদস্য হিসেবে আমন ধানের সংকরায়ণ বা ক্রসব্রিডিংয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ পান। ২০১০ সালের অক্টোবরের কথা সেটা। পিরোজপুর মঠবাড়িয়ার গুলিসাখালি রিসোর্স সেন্টারে আমন ধানের সংকরায়ণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ হয়। ফিলিপাইনের কৃষিবিজ্ঞানী ও গবেষক বংকায়া বান তাঁদের প্রশিক্ষণ দেন। ছয় দিনের প্রশিক্ষণ ছিল সেটি। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘বারসিক’ এর আয়োজন করেছিল।

প্রশিক্ষণ শেষে ২০১০ সালেই নতুন ধরনের ধান উদ্ভাবনের গবেষণায় মন দেন আরুনি সরকার। স্থানীয় কৃষক ফেডারেশন ও লোকজের সদস্যদের নিয়ে বৈঠক করেন। ঠিক করে নেন কোন কোন ধান নিয়ে গবেষণা করা হবে।

দেশীয় প্রজাতির ২০টি আমন ধানের জাত নির্বাচন করেন কৃষকেরা। ওই জাতগুলোর মধ্যে ১০টিকে মাদার বা মা এবং ১০টি জাতকে ফাদার বা বাবা হিসেবে নিয়ে শুরু হয় আরুনির গবেষণা। প্রথম বছরই কৃত্রিম পরাগায়নের মাধ্যমে স্বল্প পরিসরে ১০ ধরনের ধানের বীজ তৈরি করা হয়। পরের বছর থেকে ওই বীজগুলো খেতে লাগিয়ে ধরন নির্ধারণের চেষ্টা চলে। আট বছর ধরে এসব ধানের ফলন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে টিকে থাকার ক্ষমতা নিয়ে মাঠপর্যায়ে গবেষণা শুরু হয়। দীর্ঘ গবেষণা শেষে ছয়টি ধরনকে উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য চাষাবাদ উপযোগী হিসেবে স্বীকৃতি দেন কৃষকেরা। এগুলোর বীজ এ বছর স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে।

আরুনি সরকার বলেন, ‘গবেষণায় দেখা গেছে, ওই ছয় ধরনের ধান স্থানীয় ও উচ্চফলনশীল ধানের চেয়েও ভালো ফলন দিচ্ছে। ১০ থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত জলাবদ্ধতায় টিকে থাকতে পারে। ধানগাছগুলো তুলনামূলক মোটা হওয়ায় বাতাসে পড়ে যাওয়ার ভয় নেই।’ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আরুণির গবেষণা প্লটের ধান দেখে অনেক কৃষক মুগ্ধ হয়েছেন। নতুন ছয়টি ধান কৃষকদের কোনো উপকারে এলে তবেই ১০ বছরের গবেষণা সার্থক হবে বলে মনে করেন আরুনি সরকার।

উদ্ভাবিত ছয় ধরনের ধান
আরুনির উদ্ভাবিত ছয় ধরনের ধানের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি মেলেনি। তবে স্বীকৃতির জন্য আবেদন করা হয়েছে। লোকজ কৃষক মৈত্রী ফেডারেশন স্থানীয়ভাবে ধানগুলোর ছয়টি নাম দিয়েছেন।

জটাই বালাম (মাদার) ও বিআর–২৩ (ফাদার) জাতের মিশ্রণে যে ধান তৈরি হয়েছে, সেটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘আলো ধান’। এটি প্রতি বিঘায় ২৪ মণ পর্যন্ত উৎপাদিত হতে পারে। সাহেবকচি ও কাঁচড়া জাতের মিশ্রণে তৈরি ধানের নাম ‘লোকজ ধান’। এটি প্রতি বিঘায় ২৩ দশমিক ৮৬ মণ পর্যন্ত উৎপাদন হয়েছে। চাপশাইল ও কুমড়াগইর ধান দিয়ে তৈরি ধানের নাম রাখা হয়েছে আরুনি সরকারের নামে—‘আরুনি ধান’ । এই ধানের উৎপাদন সবচেয়ে বেশি। স্থানীয় কৃষক দেবজ্যোতি হালদার চাপশাইল ধান জমিতে চাষ করেন ২০১৯ সালে। প্রতি বিঘায় পেয়েছিলেন ১৫ মণ। গত বছর ‘আরুনি ধান’ চাষ করে প্রতি বিঘায় ২৪ মণের বেশি ধান পেয়েছেন।

এ ছাড়া বেনাপোল ও ডাকশাইল ধানের মিশ্রণে তৈরি হয়েছে ‘গঙ্গা ধান’। এর ফলন হয়েছে প্রতি বিঘায় ২১ দশমিক ২৫ মণ। বিআর–২৩ (মাদার) ও জটাই বালাম (ফাদার) জাতের ধানের মিশ্রণে তৈরি ধানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘মৈত্রী ধান’। এর উৎপাদন ২২ দশমিক ৭৫ মণ। বজ্র মুড়ি ও কুমড়াগইর ধানের মিশ্রণে তৈরি হয়েছে ‘লক্ষ্মীভোগ ধান’। এর উৎপাদন প্রতি বিঘায় ২২ মণ পর্যন্ত হতে পারে।

গবেষণায় দেখা গেছে, নতুন ধরনের ছয়টি ধানের ফলন তাদের মাদার ও ফাদার ধানের থেকে বেশি। নতুন ধরনগুলোর গাঁথুনি ঘন, শীষ লম্বা ও দুর্যোগসহিষ্ণু হয়েছে বলে জানালেন লোকজ মৈত্রী কৃষক ফেডারেশনের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ মণ্ডল। তিনি বলেন, মাদার ও ফাদার জাতগুলোর তুলনায় এগুলোর বিঘাপ্রতি ফলনও বেশি। এগুলো এখন স্বীকৃতি পেলে কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। এতে উপকৃত হবেন কৃষকেরা।

উন্নয়ন সংগঠন লোকজের সমন্বয়কারী পলাশ দাশ বলেন, ‘দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলে আরুনির নতুন ধান কৃষিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে। তাঁর উদ্ভাবিত নতুন ধানগুলো যেমন দুর্যোগসহিষ্ণু, লবণাক্তসহিষ্ণু, একই সঙ্গে অধিক ফলনশীল। কৃষকেরা স্বীকৃতির অপেক্ষায় বসে নেই। স্থানীয় কৃষকেরা এরই মধ্যে আরুনির ধানগুলো চাষ করেছেন এবং লাভবান হচ্ছেন। বড় কথা হলো, এই ধানগুলো উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে বহুজাতিক দেশি–বিদেশি কোম্পানির যে বীজ আগ্রাসন, তা কিছুটা হলেও রুখে দেওয়া যাবে।’

কোনো ধান উদ্ভাবনের স্বীকৃতির জন্য একটি নির্দিষ্ট নিয়মানুযায়ী আবেদন করতে হয়—জানালেন বটিয়াঘাটা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম। তিনি বললেন, লোকজকে ওই নিয়ম মেনে আবেদন করতে বলা হয়েছে। সে আবেদন তাঁরা করেছেন। এদিকে আস্থা নিয়ে কৃষকেরা আরুনি সরকারের নতুন ধান চাষ করছেন মাঠে। আশা করছেন ফলন ভালো পাবেন।


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: