রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ০৯:৩৪ অপরাহ্ন

শিশু পাচার প্রতিরোধে চাই সকলের সহযোগিতা-সেলিনা আক্তার

আলম সাহেবের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়েটি ছোটো, বয়স সাত। একদিন বিকেলে সে মাঠে খেলতে গেছে। সেখান থেকে সে চকলেট আনতে গিয়ে আর ফেরি নি। হায়দার আলী কৃষিকাজ করে এবং পাশাপাশি ব্যবসাও করেন। তাই সংসারে কোনো অভাবও নেই। তার তিন মেয়ে, ছেলে নেই। ব্যবসার কাজে একদিন এক ছেলে আসে। ছেলেটি হায়দার সাহেবকে বলে তার মা-বাবা নেই। সে বলে হায়দার সাহেবকে দেখতে তার বাবার মতো লাগে। হায়দার সাহেবের ছেলেটির জন্যে মায়া হয়, তাই সে ছেলেটিকে তার বাসায় নিয়ে আসে।হায়দার সাহেবের মেয়ে ময়না কিছু কেনাকাটা করবে। হায়দার সাহেবের সময় না থাকায়, ময়না তার পাতানো ভাই এর সাথে শহরে যায়। কিন্তু ছেলেটি ময়নাকে শহরের একটি বাড়িতে নিয়ে যায়। বাড়িঁর লোকজন তাকে একটি ঘরে আটকে রাখে। সেখানে ময়নাসহ আরও কয়েকটা মেয়ে ছিল। তাদের সবাইকে পাঠানো হয় পতিতালয়ে। উপরের দুটি গল্পই পাচার বিষয়ক। গল্পের প্রথম অংশে বোঝানো হয়েছে শিশুটিকে চকলেটের লোভ দেখিয়ে ধরে নিয়ে গেছে আর দ্বিতীয় অংশে বোঝানো হয়েছে আত্মীয়তার সুযোগ নিয়ে ময়নাকে পতিতালয়ে বিক্রি করা হয়েছে।

মানব পাচার একটি জঘন্য অপরাধ। মানুষের অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির মানুষ এই কাজ করে থাকে। এজন্য তারা গরিব, অসচেতন, নির্যাতিত, নারী, পুরুষ ও শিশুদের বেছে নেয়। চাকরি, ভালো বিয়ে,ও সুন্দর ভবিষত জীবনের লোভ দেখায়। তারা অসৎ উদ্দেশ্যে দেশের ভিতরে অথবা দেশের বাইরে মানুষকে বিক্রয় করে। এভাবে টাকার বিনিময়ে মানুষকে ক্রয়- বিক্রয় করার নামই মানব পাচার। শিশু পাচার হচ্ছে মানব পাচারের একটি দিক এবং জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী একজন শিশুকে অপহরণ করে দাসত্ব, জোরপূর্বক শ্রম এবং শোষণের উদ্দেশ্যে পাচার করে “নিয়োগ, স্থানান্তর, হস্তান্তর, আশ্রয়, এবং/অথবা প্রাপ্তি”। এই সংজ্ঞাটি একই নথির “ব্যক্তি পাচার” এর সংজ্ঞার তুলনায় যথেষ্ট বিস্তৃত। শিশুদের দত্তক নেওয়ার উদ্দেশ্যেও পাচার করা হতে পারে।

পাচারকারীরা শিশু সংগ্রহ অভিনব পদ্ধতিতে করে থাকে। চক্রের সদস্যারা দীর্ঘ সময় ধরে এই কাজ করে অতিগোপনে এবং সতর্কতার সঙ্গে। প্রথমে তারা শিশুটির অভিভাবকের সঙ্গে জমিয়ে তোলে ঘনিষ্ঠতা, বাড়িতে দাওয়াত করে খাওয়ানোর ঘটনাও ঘটে। এরপর সময়-সুযোগ বুঝে বিদেশে শিশু পাঠিয়ে মোটা টাকা রোজগারের লোভ দেখানো হয়। শিশুটির অভিভাবকের মনে বিশ্বাস জন্মাতে তাদেরও সঙ্গে যাওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কোনো মতে একবার রাজি করাতে পারলেই শিকার চলে আসে হাতের মুঠোয়। এছাড়াও সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে সঙ্কটে থাকা পরিবারের শিশু-কিশোরীদের পাচারের জন্য টার্গেট করছে পাচারকারীরা। এর মধ্যে ১৬ থেকে ২০ বছরের কিশোরীরা সবচেয়ে বেশি পাচারের শিকার হচ্ছে। এরপরই আছে ১১ থেকে ১৫ বছরের কিশোরীরা। ফেসবুক ও টিকটকসহ সামাজিক যোগাযোগের নানা মাধ্যম ব্যবহার করে পাচারকারীরা ভয়ানক হয়ে উঠছে।
অনেক ক্ষেত্রে চাকরি কিংবা নায়িকা বা মডেল বানানোর লোভ দেখিয়ে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাদের মানবপাচার চক্রের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। আর বিশ্বে পাচারের শিকার মানুষের মধ্যে ৭০ শতাংশই নারী ও কিশোরী। মানবপাচারের শিকার ব্যক্তিদের এক-তৃতীয়াংশই আবার শিশু। নিম্ন আয়ের দেশগুলো ধরলে সেখানে পাচারের শিকারের অর্ধেকই শিশু, যাদের বেশিরভাগকে জোরপূর্বক শ্রমের জন্য কিংবা যৌন শোষণের জন্য পাচার করা হয়।

কন্যাশিশুরা প্রতিনিয়ত পাচারের শিকার হচ্ছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অপরাধীরা। আইনি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একদিকে দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব ও নৈতিক অবক্ষয়; অন্যদিকে বিচারহীনতা। যারা পাচার হয়েছে, তারা কোনোভাবেই ভালো নেই। দেশে কিংবা দেশের বাইরে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে তারা। তাদের পরিবারের সদস্যরাও হতাশায় দিন কাটাচ্ছে। প্রতিনিয়ত দেশে ও দেশের বাইরে যৌনকর্মের জন্য কন্যাশিশুদের পাচার করা হচ্ছে। শিশু অধিকার সংগঠনের নেতারা বলছেন, যৌন কাজের উদ্দেশ্যে পাচার করা ৪০ শতাংশই শিশু। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির তথ্যমতে, গত জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত ৪০ জনের অধিক পাচার হওয়া নারী ভারত থেকে দেশে আসে। তাদের মধ্যে ৩০ শতাংশই শিশু। জানা যায়, পাচার হওয়া শিশুদের মধ্যে ৩০ শতাংশ শিশু যৌনর্কমে যুক্ত হওয়ার পর ধরা পড়ে। আর ২০ শতাংশ আগেই ধরা পড়ে দেশে ফিরে আসে। এ ছাড়া ১০ থেকে ১৫ শতাংশ শিশু প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর দেশে ফিরতে পারে। এছাড়াও সংস্থাটির তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম আট মাসে ১৩ শিশু পাচার হয়। ২০১২ থেকে ‘২০ সাল পর্যন্ত ৯ বছরে পাচার হয়েছে ৩৩২ জন। এদের মধ্যে যৌনপল্লিতে বিক্রি করা হয়েছে ১৩৩ জনকে।

ভারতে বাংলাদেশি যৌনকর্মীর চাহিদা বেশি থাকায় বাংলাদেশের দরিদ্র শিশুরা ঝুঁকিতে আছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি। শুধু ভারতের বিভিন্ন জায়গায় নয়, ভারত হয়ে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপালেও এই শিশুদের পাচার করা হয়। সীমান্তের ২৮টি পয়েন্টে নারী-শিশু পাচার হয়। এই পয়েন্টগুলোকে কঠোর নজরদারির মধ্যে আনা দরকার।

পাচারকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ আইনের ৫ ও ৬ ধারায় পাচারকারীদের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া দণ্ডবিধির ৩৭২, ৩৭৩ এবং ৩৭৪ ধারার মাধ্যমে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা আছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ এর ৬(১) ধারা অনুযায়ী শিশু পাচারকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং আর্থিক দণ্ডও হতে পারে। আবার এই আইনেরও ৬(২) ধারা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি যদি নবজাতক শিশুকে হাসপাতাল, শিশু বা মাতৃসদন, নার্সিং হোম, ক্লিনিক ইত্যাদি বা সংশ্লিষ্ট শিশুর অভিভাবকের হেফাজত থেকে চুরি করেন, তবে তিনিও শিশু পাচারের অপরাধে অপরাধী হবেন এবং একইরূপ শাস্তি পাবেন। অনেক সময় শিশুদেরকে চুরি করে নিয়ে যাওয়ার পর তাদের হাত, পা, চোখ বা অন্যকোনো অঙ্গ নষ্ট করে ফেলা হয় এবং এসব শিশুকে দিয়ে ভিক্ষা করানো হয়। দেশের একটি সংগঠিত কুচক্রী মহল এ কাজ করে থাকে। এই অপরাধ কঠোরভাবে দমন করার জন্য সরকার আইনি ব্যবস্থা নিয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১২ ধারা অনুযায়ী কোনো শিশুর অঙ্গহানি করলে বা অঙ্গ বিনষ্ট করলে যে ব্যক্তি এরকম করেছে তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং জরিমানাও হতে পারে।

পাচার প্রতিরোধে সীমান্ত এলাকায় বিজিবি ও ইউনিয়ন পরিষদের সমন্বয়ে শিশু পাচার প্রতিরোধ সেল গঠন করা প্রয়োজন। যেসব দেশে শিশু পাচার হয় সেসব দেশের সঙ্গে শিশুদের ফিরিয়ে আনা ও চুক্তির ব্যবস্থা করাসহ, আদালতে পাচারকারীদের জামিন অযোগ্য আইন করা, পাঠ্যপুস্তকে পাচারের ক্ষতিকর দিকগুলো অন্তর্ভুক্ত করা, পাচারকারীর বিচারকাজ দ্রুত শেষ করা প্রয়োজন। পাশাপাশি পাচারের ভয়াবহতা সরকারি ও বেসরকারি গণমাধ্যমে বেশি করে প্রচার করাসহ, প্রতিটি থানায় ও বর্ডার চেকপোস্টে পাচারকারীদের ছবি প্রদর্শন করার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। শিশু পাচারের সম্ভাব্য কৌশলগুলো বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।শিশু পাচার ও নির্যাতন বিষয়ে বেশি করে কর্মশালা ও সেমিনারের আয়োজন করাসহ পাচার প্রতিরোধের কাজে সংশ্লিষ্টদের সবাইকে সম্পৃক্ত করে তাদের কাজের জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি। সীমান্তে নারী ও শিশু পাচারসহ যে কোনো ধরনের মানব পাচার প্রতিরোধে বিজিবি’র কঠোর নীতি অনুসরন ও গোয়েন্দা তৎপরতার ফলে ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সীমান্তে ২৮ জন নারী, ২১ জন শিশু ও ৮২ জন পুরুষকে পাচারের কবল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া ১৫ জন পাচারকারীকে আটক ও ৩৭ টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

শিশুদের সহায়তায় কাজ করছে সরকার। দেশের যে কোনো প্রান্তে শিশুরা সহিংসতা, নির্যাতন ও শোষণের শিকার হলে বিনামূল্যে ১০৯৮ হেল্পলাইনে ফোন করে সহায়তা চাইতে পারে। গত সাড়ে পাঁচ বছরে এই হেল্পলাইনে কল এসেছে ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৩০৭টি। এর মধ্যে ৫ হাজার ৮৭২টি ছিল শিশু নির্যাতন, ৫ হাজার ৩৪৭টি পারিবারিক সমস্যা এবং ৯ হাজার ২১৩টি কল ছিল গৃহিণী ও হারিয়ে যাওয়া শিশু সম্পর্কিত। এছাড়া আইনি সহায়তা চেয়ে কল আসে ১৯ হাজার ১৩৮টি। স্বাস্থ্যবিষয়ক তথ্য ও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ৪৭ হাজার ৪৫৩ জন শিশুকে।

মানব পাচার আধুনিক সভ্যতার নিকৃষ্টতম জঘন্য অপরাধ। সরকারের পাশাপাশি আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা নিশ্চয়ই মানব পাচার, বিশেষ করে শিশু পাচাররোধে সফলতা বয়ে আনবে। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা ও সম্পর্কে সম্মানের চর্চা থাকলে নিশ্চয়ই পাচারের মতো ঘৃণ্য অপরাধ বন্ধ হবে। মানুষের প্রতি মানুষের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও মানবতাবোধ জাগ্রত হোক, জয় হোক মানবতার-এই হোক আমাদের অঙ্গীকার ও প্রত্যয়।


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: