রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ০৯:৪০ অপরাহ্ন

একটাই লক্ষ্য হতে হবে দক্ষ – মাসুদ মনোয়ার

কারিগরি শিক্ষা ক্ষেত্রে এক অনন্য উদাহরণ মোহাইমেনা বেগম। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ এটমিক এনার্জি কমিশনে প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত আছেন। সাধারণ পরিবারের মানুষের জীবনে সচারাচর যে সব ঘটনা ঘটে ঠিক তেমনি ঘটনাই ঘটেছে মোহাইমেনার জীবনে। বয়স যখন আট তখন ছোটো ভাইয়ের জন্মের সময় মায়ের অনাঙ্ক্ষিত মৃত্যু, পারিবারিক বিপর্যয় এ সবই ঘটছে তার জীবনে। কিন্তু তিনি থেমে থাকেন নি। তিন বোন আর এক ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়ো। সঙ্গত কারণেই কিশোরীকালেই তাঁকে বাবার সংসারের হাল ধরতে হয়। দাদির সাহায্যে সব ভাইবোনকে লালন-পালনের পাশাপাশি নিজের পড়াশোনাও চালিয়ে যেতে হয়। এসএসসি পাস করার পর বাবার উৎসাহে মহিলা পলিটেকনিক কলেজে ইলেক্ট্রনিকস ট্রেডে ভর্তি হন। ডিপ্লোমা পাসের পর একটি প্রাইভেট ফার্মে চাকরি নেন। এরপর ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ এটামিক এনার্জি কমিশনে যোগ দেন। চাকরিরত অবস্থায় শেষ করেন ইঞ্জিনিয়ারিং এর ব্যাচেলর ডিগ্রি। এরপর ধাপে ধাপে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে পদোন্নতি পেয়ে আজ এটামিক এনার্জি কমিশনের প্রধান প্রকৌশলী পদে কর্মরত থেকে ঐ প্রতিষ্ঠানকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতিমধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশের চারটি ভিত্তি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এগুলো হলো স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট এবং স্মার্ট সোসাইটি। স্মার্ট সিটিজেন তৈরি করতে হলে আমাদের সুশিক্ষিত এবং প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি করতে হবে। সরকার ‘এসপায়ার টু ইনোভেট-এটুআই’ তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর নাগরিক সেবা সহজিকরণে নানা উদ্বাবনী উদ্যোগে সহযোগিতা করছে। ভিশন ২০৪১ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে স্মার্ট সিটি ও স্মার্ট ভিলেজ বিনির্মাণে সহযোগিতা করছে এটুআই। ই- পার্টিসিপেশনে ২০ ধাপ এগিয়ে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ৭৫ তম এবং জাতিসংঘ ই- গভর্নমেন্ট ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্সে ৮ ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখেরও বেশি। এর মধ্যে পুরুষ ৮ কোটি ১৭ লাখেরও বেশি আর মহিলা ৮ কোটি ৩৩ লাখেরও বেশি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.২২ শতাংশ। বিশ্বে বর্তমানে কম বেশি ১৭৪ টি দেশে ১ কোটি ২০ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি কর্মরত আছে। শুধু ২০২২ বাংলাদেশ থেকে ১১ লাখেরও বেশি কর্মী বিদেশে গেছে। এরমধ্যে ২ লাখের ও বেশি দক্ষ শ্রমিক এবং ৯ লাখের ও বেশি অদক্ষ শ্রমিক। ২০২১-২২ সালে এ সব প্রবাসীরা বৈধ চ্যানেলে প্রায় ২১.০৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এক লাখেরও বেশি নারী কর্মীর বিদেশে কর্মসংস্থান হয়েছে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের থেকে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স আসার কথা তা আসছে না। এর অন্যতম কারণ হলো দক্ষ জনবলের অভাব। প্রযুক্তির উন্নয়নের কারণে সারা পৃথিবী এখন প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে যাচ্ছে। আগের মতো কায়িক শ্রমের স্হান দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে। ফলে আমাদের দেশের অদক্ষ জনবল তাদের কাজ হারাচ্ছে। এশিয়া এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার কায়িক শ্রমিকদের মধ্যে বাংলাদেশের শ্রমিকদের মজুরি সবচেয়ে কম। বিদেশে বাংলাদেশি কায়িক শ্রমিকদের মজুরি গড়ে মাসিক দুইশত ডলারের সামান্য বেশি। ঠিক একাজেই ভারতীয়দের মজুরি চারশত ডলারেরও বেশি, চীনের প্রায় সাড়ে পাঁচশত ডলার এবং ফিলিপিনোদের প্রায় ছয়শত ডলার। আমাদের দেশের শিল্প কলকারখানায় দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে।

দেশের সবচেয়ে বড়ো তৈরি পোশাক খাতে ২০ শতাংশ দক্ষ জনশক্তির ঘাটতি রয়েছে। আর এ সুযোগটি গ্রহণ করছে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলো। তাদের কয়েক হাজার দক্ষ জনবল আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পে কাজ করছে এবং তাদের উচ্চ বেতন দিতে হচ্ছে। অথচ আমাদের শ্রমিকরা বিদেশে খুব কম বেতনে কাজ করছে। আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের ৬২ শতাংশ অদক্ষ, ৩৬ শতাংশ আধা দক্ষ এবং মাত্র ২ শতাংশ দক্ষ। এদের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেছে প্রায় ২৫ শতাংশ, নিন্ম মাধ্যমিক শেষ করেছে কম বেশি ২৬ শতাংশ, মাধ্যমিক পাস করেছে ২৩ শতাংশের কিছু বেশি আর উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছে কম বেশি ১২ শতাংশ। ভাবতে কষ্ট লাগে আমরা বিদেশি দক্ষ জনবল নিয়োগ দিয়ে তাদের উচ্চ বেতন দিচ্ছি, আর আমাদের ছেলেরা নামমাত্র বেতনে মধ্যপ্রচ্যের বিভিন্ন দেশে পরিচ্ছন্নতা কর্মীর কাজ করে মানবতার জীবন অতিবাহিত করছে।
আমাদের দেশে প্রশিক্ষণকে সবচেয়ে অবহেলা করা হয়। যদিও গত এক দশকে এ ধারণাটি অনেকটা বদলেছে। গবেষণায় দেখা গেছে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতাপূর্ণ শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেলে উৎপাদনশীলতা কম বেশি ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পায় এবং এর প্রভাবে মজুরি বৃদ্ধি পায় দেড় শতাংশের মতো। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ শ্রমিকের সাথে অদক্ষ শ্রমিকের উৎপাদনশীলতার পার্থক্য কম বেশি ৮ শতাংশের মতো। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক গেছে সৌদি আরব (সাড়ে ছয় লাখেরও বেশি), ওমান (প্রায় এক লাখ বিশ হাজার), সংযুক্ত আরব আমিরাত (তিরাশি হাজারেরও বেশি), সিঙ্গাপুর (চুয়াল্লিশ হাজারেরও বেশি) ।

আর সবচেয়ে কম শ্রমিক গেছে নাইজেরিয়া (২২ জন), ইকুয়েডর (২৪), শ্রীলংকা (৭৬) এবং সুদান (৮০)। দেশে – বিদেশে সব জায়গায় এখন দক্ষ জনবলের চাহিদা বেশি। কোনো প্রতিষ্ঠানই অদক্ষ বা আধা দক্ষ জনশক্তিকে চাকরি দিতে আগ্রহী হয় না। আমাদের তৈরি পোশাক খাতে যেমন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারী শ্রমিকরা কাজ করছে এবং এ খাতে তাদের চাহিদাও আছে,তেমনি বিদেশে বিশেষ করে জর্ডান, মরিশাস,সিশেলস,কুয়েত, ক্রোয়েশিয়া,জাপান ও হংকংসহ বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে কুমিল্লা জেলা থেকে এক লাখেরও বেশি মানুষ কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে গেছে। এরপর আছে ব্রাক্ষণবাড়িয়া (৬১ হাজারেরও বেশি), চট্টগ্রাম (৫১ হাজারেরও বেশি), চাঁদপুর (প্রায় ৪২ হাজার) এবং সবচেয়ে কম মানুষ কাজ নিয়ে বিদেশে গেছে বান্দরবান (৬৫৮),পঞ্চগড়(৬৮৩), লালমনিরহাট(৭২৮)এবং রাঙ্গামাটি(৮৩৫) থেকে।

সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে গড়ে প্রতি উপজেলা থেকে এক হাজার দক্ষ শ্রমিক বিদেশে প্রেরণের বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। সে লক্ষ্যে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। দক্ষ জনশক্তি তৈরির লক্ষ্যে ৪০ টি উপজেলায় ৪০ টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং চট্টগ্রামে একটি ইন্সটিটিউট অব মেরিন টেকনোলজি স্হাপন করা হয়েছে। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো এর আওতাধীন ৬ টি ইন্সটিটিউট অব মেরিন টেকনোলজি,৬৪ টি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারসহ মোট ৭০ টি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে দেশে বিদেশে কর্মসংস্থান উপযোগী ৫৫ টি ট্রেডে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন দেশের চাহিদা অনুযায়ী প্রশিক্ষণ কারিকুলাম তৈরি করে তার মানোন্নয়ন এবং দক্ষতা সনদ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে ইতিমধ্যে কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ সকল প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন দক্ষতা উন্নয়ন কোর্স, হাউজ কিংপিং ও প্রি- ডির্পারচার ওরিয়েন্টেশন কোর্সের ভর্তি থেকে শুরু করে পুরো কোর্স অনলাইনে সম্পন্ন করে সনদপত্র ও অনলাইনে দেওয়া হচ্ছে।

এতে করে প্রশিক্ষণার্থী দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকেই পছন্দের প্রতিষ্ঠান হতে পছন্দ অনুযায়ী এ কোর্সগুলো সম্পন্ন করতে পারবেন। এতে অর্থ ও সময় বাজবে। ইতিমধ্যে এ সকল প্রতিষ্ঠান থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮ লাখ ৫৬ হাজারেরও বেশি প্রশিক্ষণার্থীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রাক বহির্গমণ ওরিয়েন্টেশন সনদ প্রদান করছে। এর মধ্যে ৩৮ হাজার ৫৭৯ জন মহিলা রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে সনদ নিয়ে ২০২১-২২ অর্থ বছরে দক্ষ জনবল হিসেবে ১ লাখ ৯৭ হাজারেরও বেশি এবং স্বল্প দক্ষ জনবল হিসেবে ২৪ হাজারেরও বেশি কর্মীর বিদেশে কর্মসংস্থান হয়েছে। দেশে বিদেশে দক্ষ ড্রাইভারের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে সরকারি অর্থায়নে ১ লাখ ২ হাজার ৪০০ জনকে দেশের ৬৪ টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ৩ মাস মেয়াদি প্রশিক্ষণ চলমান রয়েছে।
শ্রমিকদের মজুরি নির্ভর করে কাজের দক্ষতা ও দরকষাকষির সক্ষমতার উপর। দরকষাকষির সক্ষমতা নির্ভর করে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও ভাষার দক্ষতার উপর। আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের কম মজুরি মূল কারণ হলো প্রশিক্ষণ, শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা। এ ছাড়াও সংশ্লিষ্ট দেশের ভাষার উপর দখল না থাকা।বর্তমান সরকার আমাদের প্রবাসী শ্রমিকরা যে সব দেশে কাজ করছে তাদের সুবিধা অসুবিধা, সমস্যা সম্ভাবনা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে কোন দেশের জন্য কী দক্ষতার জনবল তৈরি করা দরকার তা নির্ধারণ করে সে মোতাবেক জনবল তৈরির পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।

এ সমস্ত পদক্ষেপ বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণে স্মার্ট সিটিজেন তৈরি সম্ভব হবে।


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: