শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১০:৩১ পূর্বাহ্ন

বসতবাড়িতে শাক-সবজি উৎপাদনে কালিকাপুর মডেল – এ. কে. আজাদ ফাহিম

বাংলাদেশ একটি জনসংখ্যা বহুল দেশ। এদেশে প্রায় দুই কোটি বসতবাড়ি আছে। বসতবাড়ির চারপাশের ‍কিছু পরিমাণ জায়গা সারা বছরই পতিত থাকে। এ পতিত জায়গাকে আবাদ যোগ্য করে তোলার একটি মডেল হচ্ছে- কালিকাপুর মডেল। এ মডেলে বাড়ির আঙ্গিনায় ছোট আকারের বাগান করে পরিবারের দৈনন্দিন সবজি চাহিদা পূরণ করা যায়। পাশাপাশি অতিরিক্ত আয়ও করা যায়।

তাছাড়া বর্তমানে নিরাপদ খাদ্য সময়ের দাবি। বাজার থেকে কিনতে পাওয়া সবজি কতটুকু নিরাপদ তার কোনো ঠিক নেই। তাইজন্যে নিজের বাড়ির আঙ্গিনায় নিজের পরিবারের জন্য কেউ ইচ্ছে করলেই খুব সহজে নিরাপদ সবজি উৎপাদন করতে পারেন।

আজকে আমরা কালিকাপুর মডেল সম্পর্কে জানবো।

কালিকাপুর সবজি মডেলঃ পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার কালিকাপুর নামক এলাকায় ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত গবেষণা চালিয়ে এ মডেল উদ্ভাবন করা হয়।

স্থান নির্বাচনঃ বসাতবাড়ির যেখানটায় দিনের বেশিরভাগ সময় রোদ লাগে এবং বর্ষাকালে পানি দাঁড়ায় না এমন জায়গা সবজি চাষের জন্য বেছে নিতে হবে।

বাড়ির আঙ্গিনায় আলো আসার পথে বাধা দেওয়া বড় গাছের ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে। ভবিষ্যতে বড় হয়ে ছায়া সৃষ্টি করতে পারে এমন গাছও জন্মাতে দেওয়া যাবেনা।

সবজি বাগানের আকারঃ

একই খন্ডে ১৬ ফুট x ২০ ফুট বা ৫ মিটার x ৬ মিটার মাপের জমি নিতে পারলে ভালো। তানা পাওয়া গেলে অবশ্য আঙ্গিনায় যে পরিমাণ জায়গা পাওয়া যাবে তার আকার ও আয়তনের তারতাম্য অনুযায়ী নকশার পরিবর্তন করা যেতে পারে।

বাগানের নকশাঃ

কালিকাপুর মডেল অনুসারে নির্বাচিত পতিত জায়গায় ৫টি বেড তৈরী করতে হবে। জমিতে ৫ মিটার বা ১৬ ফুট লম্বা ও ৮০ সেমি বা ৩২ ইঞ্চি চওড়া ৫টি বেড তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি ২ বেডের মাঝে ২৫ সেমি বা ১০ ইঞ্চি নালা রাখতে হবে। এ মডেলে জায়গার পরিমান বেড ও সবজির সংখ্যা বাড়লেও অন্যান্য মাপ একই থাকবে।

বাগানের জমি, বেড ও নালা তৈরীঃ

বাগানের জন্য চিহ্নিত জায়গার আবর্জনা পরিস্কার করে নিতে হবে। বেড়া দেওয়ার স্থানের ভেতরে চারপাশে জায়গা খালি রেখে নকশা অনুসারে চারদিকে ২৫-৫০ সেমি বা ১০-২০ ইঞ্চি নালা ও দুই বেডের মাঝখানে ২৫ সেমি. বা ১০ ইঞ্চি নালা তৈরি করতে হবে। নালার মাটি বেডগুলোতে তুলে দিতে হবে।

সবজি বিন্যাসঃ

কালিকাপুর মডেল অনুসারে বাড়ির পতিত জায়গা যথাযথভাবে সর্বোচ্চ ব্যবহার করে সারা বছর পারিবারিক শাক-সবজির চাহিদা মেটানো যাবে এমন সবজি বিন্যাস করতে হবে।
বছরব্যাপী ৮ থেকে ১৪ রকমের শাকসবজি অনায়াসে চাষ করা যায়।

প্রথম খণ্ডে মুলা/টমেটো ফসল উঠানোর পর পর্যায়ক্রমে লালশাক, পুঁইশাক চাষ করা যেতে পারে। দ্বিতীয় খণ্ডে লালশাক ও পর্যায়ক্রমে বেগুন, ঢেঁড়স চাষ করা হয়। তৃতীয় খণ্ডে বাটিশাক, পেঁয়াজ, গাজর, কলমিশাক ও লালশাক পরপর চাষ করতে হবে। চতুর্থ খণ্ডে পর্যায়ক্রমে রসুন, গাজর, কলমিশাক ও লালশাক। পঞ্চম খণ্ডে ফুলকপি/বাঁধাকপি, লালশাক, করলা পরপর চাষ করতে হবে।

মনে রাখতে হবে, এটি একটি মডেল। এ মডেল হুবহু অনুসরণ করতে হবে এমন কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। পারিবারিক চাহিদা, বাজারমূল্য, আবহাওয়া, স্থান, মাটির ধরন ও রুচি অনুযায়ী শাকসবজি নির্বাচন করতে হবে।

বসত বাড়িতে আরো কিছু জায়গা থাকে যেগুলোকেও সুন্দরভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে।
যেমন-
ঘরের চালঃ মাদা বা বস্তা পদ্ধতিতে লতানো জাতীয় সবজি (যেমন- চাল কুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, লাউ) লাগানো যেতে পারে।

মাঁচা/বেড়াঃ ঝিঁঙ্গা, করলা, শীম, উচ্ছে, বরবটি লাগানো যেতে পারে।
ছায়াযুক্ত স্থানঃ আদা কিংবা হলুদ লাগানো যেতে পারে।
স্যাঁতস্যাঁতে স্থানঃ কচু জাতীয় সবজি লাগানো যেতে পারে।
ঘরের আশপাশ বা বাড়ির সীমানার উঁচু জায়গাঃ যেখানে পেঁপে, সজিনা, বারমাসি কাঁচা মরিচ লাগানো যেতে পারে।

এবার সবজি চাষের জন্য কিভাবে বস্তা ও মাদা তৈরি করা যায় সে সম্পর্কে জানবো।

সবজি চাষের জন্য বস্তা প্রস্তুতকরণঃ পরিমাণমতো মাটিকে গুড়ো করে তার সঙ্গে পরিমাণ মতো জৈবসার (যেমন-পঁচা গোবর, হাঁস-মুরগির পঁচা বিষ্ঠা, গুড়ো খৈল) ও রাসায়নিক সার (যেমন- ডিএপি, এমওপি, জিপসাম, দস্তা ও বোরণ) মিশাতে হবে। এরপর সিনথেটিক বস্তা বা ব্যাগ (যেমন- সিমেণ্ট কিংবা মাছ-মুরগির ফিড, সারের পরিষ্কার বস্তা, বাজারের ব্যাগ) মুখ পর্যন্ত বস্তার তিন ভাগ মাটি ভরতে হবে। বস্তা প্রায় তিন ফুট উঁচু করতে হবে। ৭ দিন পর সেখানে সবজির বীজ বা চারা লাগাতে হবে।

মাদা তৈরীঃ একটি মাদা লম্বায় ৩ ফুট, প্রস্থে/চওড়ায় ৩ ফুট এবং গভীরতায় ৩ ফুট হতে হবে। এরপর পরিমাণ মতো মাটির সাথে জৈবসার (যেমন-পঁচা গোবর, হাঁস-মুরগির পঁচা বিষ্ঠা, গুড়ো খৈল) ও রাসায়নিক সার ( যেমন- ডিএপি, এমওপি, জিপসাম, দস্তা ও বোরণ) মিশাতে হবে। ৭ দিন পর সবজির বীজ বা চারা লাগাতে হবে।

বস্তা বা মাদায় লাউ, উচ্ছে, করলা, ঝিঙে, পুঁইশাক, মরিচ, আদা, বরবটি, মিষ্টি কুমড়া, রসুন, পিঁয়াজ ও পেঁপেসহ আপনার পছন্দ মতো বিভিন্ন প্রকার শাক-সবজির বীজ বপন বা চারা রোপণ করতে পারেন।

বসতবাড়িতে শাক-সবজি চাষ ব্যবস্থাপনায় শুধুমাত্র জমি তৈরী ছাড়া অন্যান্য কাজগুলো স্বল্প সময়ে ও কায়িক পরিশ্রমে করা যায় বলে সংসারের কাজকর্ম করেও মহিলাদের পক্ষে বাগানে কাজ করা সম্ভব। বসতবাড়িতে সবজি চাষ করে একটি পরিবার অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে এবং পরিবারের পুষ্টি চাহিদা মেটাতে পারে। এছাড়াও বড়ির আঙ্গিনায় শাক-সবজি উৎপাদন বাংলাদেশ থেকে পুষ্টিহীনতা দূরীকরণেও অবদান রাখবে।


© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২০ বাঙলার জাগরণ
কারিগরি সহযোগিতায়: